
প্রথমে বলি, আমি সেই জাতিরই একজন দূর্ভাগা সন্তান৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি, কিন্তু এই জাতির বিভিন্ন দূরাবস্থা নিয়ে লিখতে গিয়ে বারংবার এলাকার অন্ধকারে নিমজ্জিত এক শ্রেনীর মানুষের অপছন্দের পাত্র হয়েছি৷ এই জাতির মুক্তি গভীর আচ্ছন্ন মেঘে ঢাকা পড়েছে দেখে আজ আবারো এসেছি বহুবছর ধরে ধীরে ধীরে রুপ নেয়া এক মরণব্যাধি ট্রেন্ড প্রসঙ্গে৷
কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফ, বাংলাদেশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবাস হলেও বাস্তবতা হলো, এ অঞ্চল আজ মাদকসন্ত্রাস, জুয়া আর নৈতিক অবক্ষয়ের বিষাক্ত ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। পাহাড়, নদী আর সাগরের মাঝেও এখানে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য দানব “মাদক সাম্রাজ্য” যা প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে শিশুর জীবন, মায়ের কোল, স্বপ্নবান তরুণের ভবিষ্যৎ। তাই বলি আমার জন্মস্থান দেখতে যত সুশ্রী সত্যি বলতে গিলতে এর চেয়ে বেশি বিপদজনক ও কুৎসিত৷
সম্প্রতি জালিয়াপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মনখালী গ্রামে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা সেই বাস্তবতার একটি বহিঃপ্রকাশ৷ একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ধীরে ধীরে রুপ নিলো মাদকাসক্ত পিতায়, বাজার থেকে মাদক সেবন করে এসে তার ৪ বছর বয়সী কন্যাকে নির্মমভাবে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। এই ঘটনাটি শুধু একটি শিশুর মৃত্যু নয় বরং এটি একটি সমাজব্যবস্থার এবং একটি জাতির বিবেকের মৃত্যুঘণ্টা।
এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখলে আপনাদের ভুল হবে৷ সীমান্তঘেঁষা অঞ্চল উখিয়া-টেকনাফে ইয়াবা পাচার বহুকালের একটি প্রতিষ্ঠিত মরণ এজেন্ডা৷ এর পেছনে আছে দুর্বল সীমান্ত নিরাপত্তা, পাবলিকের টাকায় পালিত প্রশাসনের ভেতর শিকড় গেঁড়ে বসা হৃষ্টপুষ্ট এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ, এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়া, একশ্রেণির অর্থলোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত মহলের প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা মাদক চক্র। এইসব চক্রের কাছে আত্মসম্মান, জীবন-মূল্য, পরিবার, এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধও তুচ্ছ। একটি মাদক ও জুয়াড়ি সভ্যতা দিয়ে কিভাবে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই অঞ্চল।
এখন শুধু ইয়াবা নয়, মদ, গাঁজা ও জুয়ার আসরও নিয়মিত দৃশ্যমান প্রতিটি এলাকায়, প্রতিটি গ্রামে। সামাজিক বন্ধনগুলোতে মরিচা ধরেছে, তরুণেরা ভবিষ্যৎ গড়ার বদলে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় বিপদে পড়ছে বিশেষ করে নারীরা, শিশুরা ও প্রবীণরা। মাদকাসক্ত স্বামী বা বাবা একজন পুরুষকে শুধু নির্যাতনকারীই বানায় না, সে হয়ে ওঠে নিজ পরিবারের ঘাতকও।
এই আত্মহনন থেকে মুক্তির উত্তরণ কীভাবে? যদিও সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষুধ দিবো কোথা! তবুও কয়েকটি রিকমেন্ডেশন দিলাম৷
প্রথমত; আইন প্রয়োগ হোক কঠোর ও ন্যায়নিষ্ঠ৷ এবং সেটি হতে হবে কোনো দল-মত বিবেচনা ছাড়া। দ্বিতীয়ত; মাদক ব্যবসা এবং জুয়ায় মুনাফাভোগী সকল স্তরের গডফাদারদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷
তৃতীয়ত; প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে মাদকবিরোধী সামাজিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে এবং মসজিদের খতিব, ইমাম, শিক্ষক, ও বাছাইকৃত সৎ তরুণ নেতৃত্বকে এই যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে হবে। চতুর্থত; মাদকসেবীদের জন্য “নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র” স্থাপন ও কার্যকর করতে হবে।
এটা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের সবাইকে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে এই সর্বনাশা স্রোতের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, জাতীয়ভাবে।
এই লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। আজ যদি একটি শিশু মারা যায়, কাল হয়ত হারাবে আপনার সন্তান আপনার অজান্তেই৷ তাই এখনই সময় অন্ধ চোখে আলো দেখার, পথভ্রষ্ট ভবিষ্যৎ কে পথ দেখানোর৷ জেগে উঠুন, বদলে নিন এবং বদলে দিন৷
মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ
ছাত্র, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
পাঠকের মতামত